ABOUT FOUNDER

Sri Sri Paramananda Saraswati Maharaj

শ্রীশ্রী পরমানন্দ সরস্বতী

রাতের অখন্ড স্তব্ধতা প্রভাতের আলোয় খন্ড খন্ড হয় । জীবন নদী হয় গতিশীল । এই  বয়ে যাওয়া তরঙ্গের অভিঘাতে কাল প্রবাহের নির্দিষ্ট সন্ধিক্ষণে মহাজন পুরুষেরা যুগে যুগে পদার্পণ করেন মৃন্ময় জগতে। 

সুরমা ও কুশিয়ারা নদী বিধৌত পূণ্যভূমি শ্রীহট্ট । এই অঞ্চলে শ্রীমন্ মহাপ্রভুর কত যে ভক্ত , সাধু, সন্ন্যাসী, পীর, ফকির জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাহার ইয়ত্তা নাই । এই ঐতিহ্যপূর্ণ গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত ভূমিকে শ্রীভূমি বলা হয় । শ্রীমৎ পরমানন্দ সরস্বতীর আদি নিবাস এই স্থান ।  শ্রী শ্রী পরমানন্দ সরস্বতী জন্ম ১৩২২, ৩০  শে আষাঢ় শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে বৃহস্পতিবার সকাল 8:16 মিনিটে গৌহাটি শহরে । শ্রীহট্টের ইন্দেশ্বর পরগনার চাঁদভাগ গ্রামে আদি নিবাস । গৃহস্থ আশ্রমের নাম মৃনাল কান্তি দাস পুরকায়স্থ , জমিদারি উপাধি ‘রায়’ । পিতা নদীয়া বিহারী দাস একজন শিক্ষাবিদ — আসামের ইনস্পেক্টর অফ স্কুলস ছিলেন । সরলতা ও মহত্বের জন্য লোকে তাঁকে ” নদীয়া সাধু ” বলত । দয়াবতী ও বুদ্ধিমতী মাতা নলিনীবালা দেবী , সত্যনিষ্ঠা ও সতীত্বের প্রভাবে বাকসিদ্ধা হন । চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মৃনালকান্তি ছিলেন তৃতীয় । সত্য , ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতিমূর্তি , দাদা নির্মলকান্তি এক প্রেমসিদ্ধ মহাপুরুষ ছিলেন ।

অসুস্থতার জন্য প্রাইভেটে মেট্রিক পাস করে মৃলাল কান্তি ভর্তি হন আই .এ . ক্লাসে । অর্থকষ্টে বিপন্ন সতীর্থকে নিজের পরীক্ষার ফিসের টাকা পিতার অগোচরে দিয়ে দিলেন — পরীক্ষা আর দেওয়া হলো না, কলেজের পাঠ হল সাঙ্গ । বাড়ি বসে কাব্য, দর্শন , জ্যোতিষ, ধর্মশাস্ত্রের চর্চা করেন ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন ও ব্যুৎপত্তি লাভ হয় ।  ক্ষীণতনু হলেও বিপুল তাঁর নৈতিক বল । কৈশোরেই অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ, পীড়িতের সেবা ও অসামান্য সংগঠন শক্তির পরিচয় তাঁর বিভিন্ন কার্যে পরিস্ফুট হয় । সাহিত্যসেবায় হাতে খড়ি বাল্যেই । 

পরিনত বয়সে অনবদ্য কাব্য রচনার মধ্যে রয়েছে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর । শেষ দিন পর্যন্ত ভগবত চিন্তা ও কাব্যসাধনার যুগ্ম ধারা দুটি সমান্তরাল ভাবে তাঁর জীবনে প্রবাহিত ।

জন্মলগ্ন থেকেই এক দিব্যদৃষ্টি ছিল মৃনালের । বন্ধুরা কে কোথায় কি করছেন — তা বলা থেকে জন্ম-জন্মান্তরের কথা ও  অক্লেশে বলতেন । নিজের মন থেকে একটা নাম  জপ করতেন , পরে শ্রীমা স্বপ্নে একটি মন্ত্র বলে দেন । সেই থেকে নির্জন নিরালায় , শ্মশানে  গিয়ে জপতপ করতেন । প্রতিদিন পিতা-মাতার পাদোদক পান, হবিষ্যান্ন খাওয়া , পীর শাহজালালের দরগায় গিয়ে বসে থাকা, সন্ন্যাসী হবার স্বপ্ন দেখা — এইভাবে তাঁর দিন কেটেছে । সিলেটে টুকের বাজারের একজন ত্রিকালজ্ঞ পীর সাহেব , যার কাছে শ্রীপরমানন্দজী যাতায়াত করতেন। উভয়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক । পীরসাহেব একদিন ঠাকুরকে বললেন তুমি কি চাও বলো ? ঠাকুর প্রার্থনা করলেন আমার যেন ভগবদ্ দর্শন ও পরমার্থ লাভ হয় । এইরকম প্রার্থনা তাঁর কাছে কেউ কখনও করেনি, এই প্রার্থনা শুনে পীর সাহেবের অবিরল ধারায় অশ্রুবর্ষণ হতে থাকে…… তিনি খোদার কাছে দুহাত তুলে প্রার্থনা করে বলে উঠলেন , “খোদা এ বড় দুঃখী , তোমার বান্দার ইচ্ছা পূর্ণ করিও।” আরেকদিন তিনি ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বলেন “হালার হালা দুনিয়াটাকে হগ্গ বানাইতে চায়” । সেই সময় আরেক জন মহাত্মার সাথে ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল , তিনি হলেন সাধু মদনমোহন। এই মহাত্মা আত্মগোপন করে থাকতেন এবং ছিলেন গৃহী। নিতান্ত সৌভাগ্যবান ভক্তের কাছে তার স্বরূপ প্রকাশ পেত । এই নিত্যসিদ্ধ মহাত্মার সঙ্গে ঠাকুরের ছিল আত্মিক যোগ ।

শক্তিশালি সাধু সূর্যানন্দের খবর পেয়ে মৃণাল যেতেই সাধু বললেন ‘আমি তোমার জন্যই বসে আছি’ ।  কয়েক দিনের মধ্যে তন্ত্রমতে দীক্ষা দিলেন এই সাধু –১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (1942 সালে) যোগেশ দাসের বাড়িতে , শিবগঞ্জে । সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলেন সর্বাঙ্গে এক প্রচন্ড জ্বালা — প্রবল জ্বর এলো । এই জ্বালা ও জ্বর আর ছাড়ে না । দীক্ষার ষষ্ঠ রাতে নিজের ঘরে একাকী নাম করছেন মৃণাল ,– সেদিন ঝুলন পূর্ণিমা ছিল,  সহসা ঘর আলোকিত হয়ে উঠল , ভগবান শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণ প্রত্যক্ষভাবে দর্শন দান করে মৃনালকে যথারীতি সাধন দিলেন ( দীক্ষা)  দিলেন । মৃনালের শরীর জুড়িয়ে গেল । আকাশ-বাতাস মধুময় মনে হল , গাছের পাতার মর্মরে  বাঁশির ধ্বনি শুনতে পেলেন । বাহ্যজ্ঞান শূন্য অবস্থায় দিব্যোন্মাদের মত প্রায় পক্ষকাল কাটল — এমনই অবস্থা যেন অমৃত সাগরে ভাসছেন । দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতা-মাতা খাটকলে গুরু  সূর্যানন্দের কাছে পাঠিয়ে দিলেন । সেখানে মৃণাল গোপনে নতুন নাম সাধন করতে শুরু করেন ।

সদ্গুরু   শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণের দীক্ষা পেলেও সূর্যনন্দজীর কঠোর শাসন ও অকল্পনীয় পরীক্ষা এবং জীবন গঠনের বহু শিক্ষা ও নির্দেশ মৃণালকান্তি শিরোধার্য করে নেন । লৌকিক গুরুর সেবায় তিনি প্রাণ ঢেলে দেন এবং তাঁরই নির্দেশে বহু জায়গায় সাধন-ভজন করে ভগবত কৃপা লাভ করেন । বাংলা ১৩৫০ -এর মাঘের শুক্লা পঞ্চমী তে (ইংরেজি 1944 সালে শিলং এর অধিবাসী প্রবীর চক্রবর্তীর বাড়িতে) সূর্যানন্দজীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে পরমানন্দ সরস্বতী নাম ধারণ করেন । কিছুদিন পর  তাঁর লৌকিক গুরুর নির্দেশে  তিনি স্বাধীনভাবে পরমার্থ সাধনে ব্রতী হন । প্রথমে আসেন শিলংয়ের লাবাংয়ে খাদিমনগর স্টেট এর কাছে পরিতোলা জঙ্গলে । সেখানে নির্জনে কিছুদিন সাধন-ভজন করার পর তিনি চলে যান চট্টগ্রামে জঙ্গলাকীর্ণ নির্জন স্থানে । এই সময় থেকে প্রভুপাদ বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর দৈবাদেশ দ্বারা তিনি চালিত হতেন । তিনি বেশ কিছুদিন  সাধন ভজন করেন কামাখ্যা পর্বতে  এবং  মা কামাখ্যা  এবং ভুবনেশ্বরী মায়ের বিশেষ কৃপা লাভ করেন । মাতা ভুবনেশ্বরী কুমারী বেশে শ্রীশ্রী পরমানন্দকে দর্শন দান করেন । প্রভু বিজয়কৃষ্ণের দেওয়া সাধনের কথা  1948 সনে প্রকাশ পায় , শ্রীপরমানন্দ সদগুরু শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণের নির্দেশে  সনাতন ধর্ম প্রচার  সুস্থ সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে সাধন দান আরম্ভ করেন এবং ওই বছর প্রথম দীক্ষা দেন  । পরমানন্দজী দীক্ষা দানের প্রাক্কালে দীক্ষার্থীদের বলতেন — গোস্বামী প্রভুর উপস্থিতিতে ও তাঁর নির্দেশেই  এই সাধন তিনি দিচ্ছেন । শুধু দীক্ষা দানই নয় বস্তুত নিত্যকার সবকিছুই তিনি গোস্বামী প্রভুর নির্দেশ ছাড়া করতেন না — এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে ।

 শ্রী শ্রী ঠাকুরের অনন্ত ভাব অনন্ত লীলা । প্রভুপাদ শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর  আরব্ধ কর্ম “শ্রীশ্রী নামব্রহ্মের”  প্রচার ও প্রসারে শ্রী পরমানন্দ সরস্বতী এই দেবদুর্লভ অপার্থিব বস্তু মানুষের ঘরে ঘরে স্থাপন করেছেন, প্রচার করেছেন ।  সমাজের অন্ধকার দূর করতে এই আলোর বর্তিকা মানুষের হাতে হাতে  বিতরণ করেছেন । প্রচার করেছেন  “নামব্রহ্মের” মাহাত্ম্য । মানুষের ঘরে ঘরে জ্বেলেছেন “নামব্রহ্মের” আলো । সমস্ত শাস্ত্রের সারনির্যাসের সমন্বয় রূপ “আশ্রম কথা” মহাগ্রন্থে নামব্রহ্মের সুদুর্লভ শাস্ত্রীয় প্রামাণ্য মত স্থাপন করেছেন । 

শ্রীমৎ পরমানন্দ সরস্বতীর অভিনব এক রূপের বর্ণনা দিয়েছেন শিষ্য কৃষ্ণজীবন গুপ্ত মহাশয় একটি লেখায় । তিনি লিখেছেন  গুরু-শিষ্য সম্পর্ক আত্মার এবং মধুর। শিষ্যের হৃদয়ে গুরুর বাস । কৃষ্ণজীবন গুপ্তের কথায়, অমন অকৃত্রিম বন্ধু, এমন দরদী প্রান আমার জীবনে আর দেখিনি । মুক্তি , মোক্ষ,  কৈবল্য কিংবা প্রেমভক্তি কোনটার আকর্ষণ সেদিনও ছিল না ,আজও নেই । তাঁর কথায় আমরা কোন দুর্বার ভালোবাসার  টানে আমার গুরুর সংস্পর্শে এসেছিলাম । প্রেমভক্তি  কিংবা মোক্ষলাভ করব এরকম কোন কিছুই  মনের মধ্যে ছিল না । শুধু ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসা । এমনই অমোঘ ছিল  তাঁর প্রেম । শুধু একটি কথাতেই মনে হতো ইনিই মনের মানুষ , ইনি আপনজন । 

শ্রীশ্রী গোঁসাইজীর  জামাতা জগবন্ধু মিত্র মহাশয়ের শিষ্যা সরোজিনী মিত্র ”মামনি নামে” শ্রীক্ষেত্রে ভক্ত সমাজে পরিচিত ছিলেন । 1356 সালের গোস্বামী প্রভুর অশেষ কৃপায় তিনি লীলা দর্শনের অধিকার লাভ করেন । মামনি তাঁর “জীবন গাঁথা” গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের 127 পৃষ্ঠায় লিখেছেন—-“6ই চৈত্র, 1372 সালে শ্রীশ্রী গোঁসাইজীর নির্দেশ অনুযায়ী আমি স্বামীজি ( শ্রীমৎ পরমানন্দ সরস্বতী) সঙ্গে দেখা করতে যাই । তখন তিনি শ্রীক্ষেত্রে স্বর্গদ্বারে নানক মঠে ছিলেন । ……….. গোঁসাইজী জানান, মা আমি ওঁর মধ্যে বাস করি , আমার প্রিয় ভক্ত, আমার অসম্পূর্ণ কার্য ওর দ্বারা সম্পূর্ণ হবে ।”…… একদিন শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দ সরস্বতীজী মামণির হাতে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের চরণ তুলসী দেবার সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেন — গোস্বামী প্রভু স্বয়ং তাঁকে ওই চরণ তুলসী দিচ্ছেন ।

তিরিশের দশকের শ্রীহট্টের উদীয়মান কবিদের অগ্রগণ্য মৃনালকান্তি রবীন্দ্রোত্তর যুগের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ।  রস, তত্ত্ব ও জ্ঞানের ত্রিবেণী সঙ্গম হয়েছিল তাঁর কাব্যে । প্রেম তাঁকে করেছিল মধুময়, গীতিময় ।  জীবনমুখী কাব্যকে তিনি করেছিলেন শিল্পময় । ভাগবত সাধনায় আত্মনিয়োগ করে তিনি হন সিদ্ধকাম । সন্ন্যাসী হয়েও সমাজবিমুখ ছিলেন না । কবি মৃণালকান্তি  (সন্ন্যাসোত্তর নাম শ্রী পরমানন্দ সরস্বতী ) ছিলেন প্রচার বিমুখ , কিন্তু তাঁর রচিত কাব্য সমকালীন কবি-সাহিত্যিক মহলে সাগ্রহে সমাদৃত হোত । তাঁর রচনা পরিমাণে কম হলেও প্রসাদগুণে অনেক বেশি সমৃদ্ধ । কিছুসংখ্যক সাহিত্যসেবীদের মতে এগুলি মহাজনপদ তুল্য ।  শ্রদ্ধেয় শ্রী অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত মহাশয়ের ভাষায় ‘কবি পরমানন্দের এক একটি কবিতা এক একটি হীরের টুকরো—-কালের ভঙ্গুর কাঁচ কেটে কেটে দিচ্ছে । সেই আঘাতেই কত দুতি, কত স্নেহ , কত আত্মীয়তা ।  মনে হয়েছে যেন জপোজ্জল মন্ত্রের ঝংকার — গভীর  কোন উপলব্ধির উচ্চারণ । তাঁর আসন পীঠ গহন নির্জন অন্তর্লোকে এক মহান কল্প বৃক্ষের নিচে — আর এই কবিতাগুলি সেই কল্প বৃক্ষের ফুল ও ফল’ । শ্রী শ্রী  পরমানন্দ সরস্বতী লিখিত কাব্যগ্রন্থ—-ক) আকাশ খ) দিগন্ত গ) ইশারা ঘ) উত্তর বসন্ত ঙ) আশ্রম কথা চ) অক্ষর ( 2 খন্ড)  ছ) নির্জন স্বাক্ষর  জ) নির্জন প্রহর ঝ)আহিতাগ্নি ঞ)পুনর্বসু ট) পঞ্চমুখ ঠ)বসন্ত বহ্নি ড) কালমৃগয়া চ) আনন্দ জাতক ছ) উত্তর মীমাংসা ত) নিঃসঙ্গ মাথুর থ) কালপুরুষের কড়চা দ) নিরুক্ত ধ) নিগম  ন) অন্তরঙ্গ প) অভিজ্ঞান ফ) বহুরূপী ব) যেখানে কমল সেখানে কাঁটা ভ) ধুলোর প্রদীপে আলোর শিখা।

এই অবক্ষয়ের যুগে , মূল্যবোধহীন সমাজে, দিকভ্রান্ত জনমানসকে তিনি দিয়েছেন এক মহৎ জীবন দর্শন । শ্রী পরমানন্দ মাতৃসাধনা, সুফিমতে সাধনা , বাউল ভাবের সাধনা এবং বৈষ্ণব সাধনার বহু ধারায় নিজে মজে অন্যকে  মজালেন । তাঁর দিব্য অনুরাগের আলো জ্বললো হাজার হাজার কবিতা ও গানের শিখায় । ব্রজপ্রেমের দিব্যরাগে, আনন্দরাসে মিলিত সংগীত ও কবিতাগুলির কান্তাভাব তুলনাবিহীন । তিনি ধুলোর প্রদীপে আলোর শিখা জ্বেলেছেন  কত মানবাত্মার  গুহায়িত আঁধারের হৃদয় ভূমিতে । তিনি রস হয়ে , গুন হয়ে, গান হয়ে , আম্রবৃক্ষে মধু হয়ে, মানুষের অন্তরে স্বর্গের বাগান তৈরির চেষ্টা করে চলেছেন । আমাদের হাতে সাধনের আলোর প্রদীপ তুলে দিয়ে দিব্যজীবনের পথ দেখাতে চেয়েছেন । 

1980 সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার উত্তর উপকণ্ঠে   নিকট একজনকে ঠাকুরজী বললেন, “আজকে এক আশ্চর্য কথা বলব । কথাটা হচ্ছে এই যে “1980 তে আমি করিমগঞ্জ চলে যাব —আর আসব না “। অন্য এক ভক্ত কে একদিন বললেন— করিমগঞ্জে মাটির নিচে ঘর করে আমি থাকবো । কারো সঙ্গে দেখা হবে না ।

তিনি শঙ্করলাল সাহার বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করে সেখান থেকে আসলেন শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণ পল্লীতে অমিয় চৌধুরী মহাশয়ের বাড়িতে । ঠাকুরের অমোঘ আকর্ষণে তখন শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণ পল্লীতে প্রাণের স্পন্দন ,  আনন্দের হাট । পাঠ, কীর্তন, প্রসাদ ও শ্রীশ্রী ঠাকুরের  প্রেম পূর্ণ মধুর ব্যবহারে দিনগুলো  অপ্রাকৃত ভূমিতে পরিণত হয়েছিল । দিবারাত্র হরিধ্বনি তে মাতোয়ারা  পল্লী তখন  আনন্দ নিকেতন । ইতিমধ্যে হঠাৎ করিমগঞ্জে দুর্গানগর যাওয়ার জন্য চিঠি ও টেলিগ্রাম আসতে লাগলো । করিমগঞ্জে যেতে তিনি কিছু বিলম্ব করছিলেন । শ্রীযুক্ত হরিদাস বাবু করিমগঞ্জ থেকে কলকাতায় চলে এলেন ঠাকুরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।  সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেল । শেষ বিদায়ের মহালগ্ন উপস্থিত হল । পল্লীবাসীদের  হৃদয়ে অব্যক্ত বেদনার কম্পন । ঠাকুর নীরব থেকে দু একজন কে সঙ্গে নিয়ে পল্লী পরিদর্শনে বেরোলেন । পল্লী থেকে বিদায় নেয়ার সময় বাল্যবন্ধু শ্রীযুক্ত সুলীনেন্দ্র মহাশয়ের গলায় পরিয়ে দিলেন নিজের গলার মালা খানি । ঠিক এই মহা বিদায়ের মুহূর্তে একটি ছোট্ট মেয়ে, নাম সোমা দত্ত হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে শ্রীশ্রীঠাকুরজীর দিকে চেয়ে চিৎকার করে পা জড়িয়ে কেঁদে বলল — “তুমি তো এখানে আর আসবে না”,  । শ্রীশ্রী ঠাকুর বেদনামিশ্রিত সুরে বললেন, “কেন?” এই কেনর উত্তর সে দিল না, আর কেউই দিলেন না, আমরাও দিলাম না, এই কেনর উত্তর জানতেন কেবল অন্তর্যামী । গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে তিনি বললেন “যত্র ধর্ম তত্র জয় ” শ্রী শ্রী ঠাকুরজীর গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো । আর অল্পক্ষণের মধ্যে সকলের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল ।

এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর করিমগঞ্জ বাসীকে দিন কয়েক মধুর সঙ্গ দান করে হঠাৎ অন্তর্ধান করলেন । রাত্রে বললেন আমি এমন জায়গায় চলে যাব তোমরা আমাকে দেখতে পাবে না , কিন্তু আমি তোমাদের সকলকে দেখব । এই কথা বলে তিনি ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বললেন –“তোমরা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ”?  অনেকে বললেন না ঠাকুর , আমরা আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না । শ্রী শ্রী ঠাকুরজী পুনরায় বললেন আমি কিন্তু তোমাদের সকলকে দেখতে পাচ্ছি । পরের দিন ছিল শনিবার , অম্বুবাচী । ইংরেজি 1980 সালের 7 ই আষাঢ় । বেলা 09:45 সময় করিমগঞ্জ শহরের শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত সুধাংশু দেবের বাড়িতে তিনি মহাসমাধি লাভ করলেন ।

তিনি  লীলা সংবরণের প্রস্তুতি  নিয়েছিলেন সকলের অজ্ঞাতে, সকলের অজান্তে । আর তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন   অনেক  আগে থেকেই । কেউ ধরতে পারেনি । করিমগঞ্জের কাছে এক দুর্গম অঞ্চল দুর্গানগরে তিনি কোদাল হাতে নিয়ে কেন যে গর্ত করতেন , কারো মনে কোন প্রশ্ন ওঠেনি কখনো তা নিয়ে । আসল কারণ ছিল — দেহত্যাগের সময় নির্ধারিত  করে রেখেছিলেন আগে থেকেই ।  দেহত্যাগের নির্দিষ্ট সময়ে অম্বুবাচী থাকবে জেনে তিনি নিজের স্থান প্রস্তুত করে রেখেছিলেন । তিনি যে চিরজাগ্রত, চিরনির্ভর প্রতিমুহূর্তে সেই কথা  জানিয়ে যান — বারেবারে… নানাভাবে ….বহুভাবে ।  ১৩৮৭, ৭ই আষাঢ় (ইং 1980, 21শে জুন) শনিবার বেলা 09:45 মিঃ তিনি কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ শহরে মহাসমাধি লাভ করেন । এই মহাজীবনের আলোর প্রপাতে ধন্য হোক ধরাতল । তিনি আজও নিত্যবর্তমান ।

অবতার পুরুষের মৃত্যু হয় না । এঁদের লীলার শেষ নেই । এঁরা অপ্রকট কালেও প্রকট হন । শ্রী শ্রী পরমানন্দ যে অপ্রকট অবস্থায় নানাভাবে অলৌকিক লীলা করে চলেছেন । ভক্তরা সেসব অবগত আছেন। কখনো চতুর্দিকে দিব্য সুগন্ধ ছড়িয়ে , কখনো আসনে চরণচিহ্ন রেখে,  কখনো স্বপ্নাদেশ দিয়ে , কখনো আত্মিক আবেশে , কখনো দেহে প্রকট হয়ে তিনি আশ্চর্য লীলা করে চলেছেন আজও ।