SRI SRI BIJOY KRISHNA GOSWAMI
“ ঈশ্বরের দূতও বিজ্ঞজনের নিকট দুজ্ঞেয় । যার চিত্তে কৃষ্ণপ্রেমা করয়ে উদয় । তার বাক্য ক্রিয়া – মুদ্রা বিজ্ঞে না বুঝয় । সে ক্ষেত্রে নররূপে অবতীর্ন ঈশ্বরকে চেনা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব । কোন মানবীয় বুদ্ধি দ্বারা তাঁকে জানা যায় না । যিনি নিত্যযুক্ত , তিনিই জানেন । এক অচিন্ত পুরুষ বিজয়কৃষ্ণ । তিনি সাধু নন – সাধ্য , সাধুরও সাধনার ধন। কর্মে , জ্ঞানে ,প্রেমে , দয়া ও দানে তিনি অতুলনীয় । যখন তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক তখন তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে , সকলের প্রধান । অদম্য ,অক্লান্তকর্মী – কখনো অঞ্জলিভরে জল পান করে – কখনো কাদামাটি , কখনো শুধু গাঁদাফুল ভাজা খেয়ে তাঁর দিন কেটেছে ।
তিনি জ্ঞানে ছিলেন কাল অপেক্ষা বৃদ্ধ – সর্বজ্ঞ , সর্বতত্ত্বজ্ঞ এক উজ্জ্বল শাস্ত্রমূর্তি । তিনি বলেছিলেন , সমস্ত শাস্ত্র আমার নিকট পাখির ঝাঁকের মত প্রকাশিত হয় , আমার সাথে কথা বলে । যেমন বালক সমুদ্র দর্শনে বিস্মিত হয় , তেমনি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল তাঁর সঙ্গে দার্শনিক বিষয়ে আলাপ করে অভিভূত হন । অকপটে স্বীকার করেন , বিজয়কৃষ্ণের জ্ঞানের কাছে তাঁর দার্শনিক জ্ঞান ও অনুভব অতি অকিঞ্চিৎকর ।
বিজয়কৃষ্ণ বৈরাগ্যে ছিলেন শিব , আকাশবৃত্তি ছিল তাঁর অবলম্বন । বহু আশ্রিতজনের ভার তিনি বহন করেছেন , কিন্তু একটি কপর্দকের জন্যও তিনি কখনো কারো নিকট প্রার্থী হন নি । তিনি দয়া ও দানে ছিলেন গঙ্গা যমুনা । পশুপক্ষী , বৃক্ষপতাও তাঁর দয়া থেকে বঞ্চিত হয় নি । আশ্রমের নিভৃত কোণে আমগাছে রাখাল বালকেরা পেরেক ফুটিয়েছে , কুটিরে বসে তারো দুঃখ তিনি অনুভব করেছেন ।
প্রেমে এই মহান্ত পুরুষ ছিলেন অসাধারণ । – পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রেম যদি পুঞ্জীভূত করা যায় , বিজয়কৃষ্ণের প্রেমের কাছে তা এক বিন্দু । তিনি মহাপ্রেমের ভান্ডারী ছিলেন । বিজয়কৃষ্ণের মধ্যে প্রেমের যে তুরীয় তন্ময় প্রকাশ হয়েছিল , একমাত্র শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গেই তা তুলনীয় । প্রেমে মহাভাবে খাড়া হয়ে হয়ে উঠত তাঁর বিরাট জটাভার , পিচকারীর ধারার মত বর্ষিত হত অশ্রু ।শ্রীবৃন্দাবনে যোগমায়া দেবী অন্তর্ধান করলেন , কন্যা কুতুবুড়ি পিতার গায়ে হাত বুলাতে গেছেন , গায়ে হাত দিতেই ফোস্কা পড়ে গেলো হাতে । একবার পূর্ববঙ্গে ধামরাই – এর মাধব মন্দিরে বারান্দায় বসে আছেন , অচিন্ত্য প্রেমানুভূতিতে তাঁর দক্ষিণপদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্টি থেকে জল্ধারা নির্গত হয় এবং তাতে মন্দিরের চত্বরের একাংশ সিক্ত হয়ে ওঠে । দেবগনের স্তব গানে বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর এরূপ হয়েছিল – সেই জলধারা থেকেই গঙ্গার জন্ম ।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বিষ্ণুখট্টায় বসে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন , “ মুই সেই মুই সেই “। অদ্বৈত অঙ্গনে নিজেকে প্রকাশ করেন পুরাণ-পুরুষরূপে – উপস্থিত অগণিত ভক্তদের বিলান করুণা প্রসাদ , তাঁহার ইহকালের পরকালের সকল দায় নিয়ে দেন চিরকালের ধন । সেদিন গর্ভধারিণী শ্চীমাতার মাথায় তুলে দেন যুগল চরণ । দেশে দেশে ভ্রমণ করেছেন আহারহীন , আশ্রয়হীন এক অপরিচিত অবধূতের বেশে ধর্মপ্রচারে , লুপ্ততীর্থ উদ্ধারে । কত মনে , জনজীবনে জ্বেলেছেন ভক্তিদীপ , জনে জনে বিলিয়েছেন নাম প্রেম । কত দীর্ঘ দুর্গম পথ , নদী পর্বত , ধূ ধূ প্রান্তর অতিক্রম করেছেন , একটি মাত্র সঙ্গী নিয়ে কত অনাত্মীয় গ্রাম ও নগরে ঘুরেছেন একা একা – মানুষের জন্য মানুষের দেবতা কত ত্যাগ , কত দুঃখ বরণ করেছেন – প্রভু হয়ে হয়েছেন সেবক , কালের শাসক হয়েছেন তৃণাদপি নীচ , জনার্দন হয়েছেন জন – তোষক – পাপীকে দিয়েছেন আশ্রয় , অধম অস্পৃশ্যকে আলিঙ্গন , অমানীকে দিয়েছেন মান , ভক্তজনকে দেবতার সম্মান । আর নিজের পার্ষদগনকে দেশে দেশে ধর্মপ্রচারে , প্রবর্তনে , শাস্ত্রগ্রন্থ প্রণয়নে , সৎসাহিত্য রচনায় নিযুক্ত করেছেন । বৈষ্ণব পদাবলী পৃথিবীর সম্পদ – এমন রসসমৃদ্ধ পদ কোন কালে , পৃথিবীর কোন দেশে রচিত হয়নি । আর লোকের পায়ে ধরে পথের সন্ধান দিতে বলেছেন ভক্তদের – আবার তাঁর প্রচারক পার্যদজনকে আশ্বাস দেবার জন্য বলেছেন – “ পৃথিবীতে আছে যত নগর ও গ্রাম । সর্বত্র প্রচারিত হবে মোর নাম ।“
তিনি যে সাধন প্রনালী প্রবর্তন করেছেন তারও তুলনা নেই । যে সাধন সত্য ও ত্রেতা যুগে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক সর্বত্যাগী সাধু সন্ন্যাসীর মধ্যে প্রবর্তিত ছিল , যে দুর্লভ সম্পদ মহাপ্রভু মাত্র সাড়ে তিনজনকে দান করেছিলেন , সেই সম্পদ তিনি সাধারণে , অধম অকিঞ্চনে অকাতরে বিতরণ করেছেন । শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ বলেছেন “ আমি যে বস্তু দিলাম , মাথা কুটেও আর কোথাও তা পাবে না । জগতে যত রকম সাধন প্রনালী প্রবর্তিত আছে , তাতে যা কিছু লাভ হয় , তার সমস্তই এই সাধন দ্বারা লাভ হবে – উপরন্তু প্রেমভক্তি লাভ হবে । “ তিনি যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা সর্বশাস্ত্রের সারাৎসার ।
শ্রীমৎ পরমানন্দ সরস্বতী মহারাজ